ফটোগ্রাফ(২০১৯): প্রেমের মতো কিন্ত প্রেম নয়




ট্যুরিস্ট স্পটের ভাসমান ফটোগ্রাফার আর শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের দারুণ মেধাবী এক তরূণীর রহস্যময় সাক্ষাৎ, যোগাযোগ ও পরস্পরের জীবনে শর্তহীন ভাবে ভ্রমণের গল্প হচ্ছে রিতেশ বাতরার দ্বিতীয় হিন্দি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ফটোগ্রাফ(২০১৯)। ২০১৯ সালের সানড্যান্স চলচ্চিত্র উৎসবে রিতেশ বাতরা নিজের সিনেমা সম্পর্কে বলেন, ”প্রেমের মতো কিন্ত পুরোপুরি প্রেম নয়” এই সিনেমা। কেন নয়, জানতে হলে দেখে ফেলতে হবে ক্রমাগত নিজেকে ভেঙ্গে গড়া নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী এবং চোখ জুড়ানো মন ভরানো অভিনয় করা সোনিয়া মালহোত্রার প্রায় প্রেমের এই সিনেমাটি।

প্লট
ছবির নায়িকা মিলোনিঃ লাজুক, অন্তর্মুখী, গুজরাটের মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন লেখাপড়ায় দারুণ মাথা এক মেয়ে। চাঁপা স্বভাবের মিলোনি কে দেখে অন্যরকম লাগতে শুরু করে রাফির, যে কিনা মুম্বাই এর একজন ভাসমান ফটোগ্রাফার, নিজের পরিবারের দেনা পরিশোধের জন্য দিন রাত কাজ করছে । রাফি ও মিলোনির যোগাযোগ হঠাৎ ও আকস্মিক, সম্পর্কের পরবর্তী গতি প্রকৃতি এরকমঃ রাফির দাদী তাকে বিয়ে করাতে চাপ দেয়, জবাবে রাফি চিঠি লিখে পাঠায় সে একজন কে পছন্দ করে, যার নাম সে দেয় নূরী। এই নূরীই হচ্ছে আমাদের মিলোনি। এরপর রাফির দাদী গ্রাম থেকে শহরে আসে পাত্রী দেখতে। সিনেমা ঠিক সেই মূহুর্ত থেকেই শুরু, কি হবে এখন? ধর্ম, শ্রেণী, বিত্ত, রূপ, শিক্ষা, বাসস্থান, অভ্যাস ইত্যাদি সামাজিক মাপকাঠিতে তারা একে অপরের থেকে যোজন যোজন দূরে। সাধারণ চোখে তাদের যোগাযোগ অসম্ভম ও নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই না- এর মধ্য থেকেই অদ্ভুত এক সম্পর্কের বয়ান হাজির করেছেন রিতেশ বাতরা। না, আগের যুগের সিনেমার মতো কিছুতেই এটি ধনী-গরীবের চিরায়ত কচকচি নয়, বরং বাস্তবতার কাছে ভীড়ে এক পরাবাস্তব, স্বপ্নময় সম্পর্কের গল্প হচ্ছে ফটোগ্রাফ।
সোনিয়া মালহোত্রা ও নওঁয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী
সিনেমার যা কিছু নজরকাড়া/ যা কিছু নয় (যারা সিনেমা দেখেননি, এই অংশ সিনেমা দেখে পড়লে উত্তম)


“কাম্পা কোলা” সিনেমার একটি শক্তিশালী রূপক। অনেকটা রাফি-মিলোনির সম্পর্কের মতোঃ বাতিল, অজ্ঞাত, অসম্ভব, মেয়াদোত্তীর্ণ। কাম্পা কোলা উৎপাদনকারী কোম্পানি উঠে যাবার পরেও রাফি যেভাবে কষ্ট করে কাম্পা কোলা খুঁজে বের করে জোগাড় করে, তার সেই পরিশ্রম কে আমরা তার মিলোনির সাথে থাকতে চাওয়ার মরিয়া ইচ্ছার পাশাপাশি রাখতে পারি। কাম্পা কোলা যেন রাফির প্রচেষ্টা, আর মিলোনির কাম্পা কোলা ভালোবাসার ইচ্ছা যেন অবাস্তব কোনো কিছুর প্রতি মোহ।


সিনেমার গল্প মানুষের যোগাযোগ ঘিরে হলেও যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে ঠিক কি কারনে মিলোনি ও রাফি পরস্পরের সাথে যোগাযোগে আগ্রহী হয়ে উঠে? অর্থাৎ তাদের নিজেদের জগতের অস্বস্তি, অসুবিধা, অসন্তোষ, অতৃপ্তি ইত্যাদি বিষয়গুলোর পরিষ্কার ইঙ্গিত নেই। যে কারনে তারা পরস্পরের প্রতি আগ্রহী হয়ে নিজেদের সীমানার বাইরে যেতে চায় তার কোনো আপাত পরিষ্কার ব্যাখ্যা নাই। যে কারনে কেউ যদি প্রশ্ন করেন, মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন মেধাবী ছাত্রী কোন দুঃখে রাস্তার এক অশিক্ষিত মূর্খ ফটোগ্রাফারের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখবে? যদিও খুব অল্প কিছু ইঙ্গিত আমরা পাই যে মিলোনি তার নিজস্ব চিন্তাভাবনায় খুব কম সময় কাজ করতে পেরেছে, বেশির ভাগ সময়ে সে তার বাবা-মায়ের ইচ্ছাতেই সব কাজ করেঃ লেখাপড়া, বিয়ে ইত্যাদি। ব্যাপারটা অনেকটা বাস্তবের কাছাকাছি বলে ভাবা যেতে পারে যে, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে পলায়নপর যেই মনোবৃত্তি আছে, মিলোনি ও রাফি প্রথম সুযোগেই সেটা হাতছাড়া করেনি। সেটা দেখতে যতো অসম্ভব ই হোক না কেন, এটা তাদের এক ধরনের পলায়ন, নিজের জগত থেকে অন্য আরেক জগতে যাওয়ার চেষ্টা, একটা পাগলা ভ্রমণ যার ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের বড় রকম কোনো চিন্তা নেই, আছে শুধু ভ্রমণের সময়টা উপভোগের চেষ্টা। কোনো ধরনের লক্ষ্য না থাকার কারণেই কিনা, তারা যাত্রাপথে খেয়াল করতে পারে অনেক কিছু, ঘুরে বেড়াতে পারে ইচ্ছা মতো, স্বাধীন ও মুক্ত! যেন দুটি খাঁচা থেকে দুটি পাখি শুধুমাত্র বিশাল আকাশে উড়াউড়ি করাই বেছে নিয়েছে।
তাই বলে তাদের সম্পর্কটা মোটেও শারীরিক নয়, যেটি পরবর্তী পয়েন্টে আলোচনা করছি।

মিলোনি-রাফি


সিনেমার শেষ দৃশ্যের ব্যাখ্যা দেয়া যায় এভাবে যে, সিনেমা-হলে যখন ইদুর মিলোনির পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়, তখন নূরী অস্বস্তি বোধ করে। কেন? তার সাথে রাফির যে সম্পর্ক তাকে যদি ভালোবাসা বলে ধরে নেন, সেটা আসলে কেমন ভালোবাসা? শরীরী না অশরীরী(প্লাটোনিক নাকি ফিজিকাল?) বুদ্ধিমান দর্শক অবলীলায় বলবেন, অবশ্যই অশরীরী/শরীর ছাড়া(প্লাটোনিক)। যেহেতু মিলোনি শুধুই নূরী হয়ে প্রাগৈতিহাসিক এক স্বাদ নিতে চায়, ইদুরের স্পর্শ তাকে অস্বস্তি বোধ করায়, জাত-পাত-স্থান-কাল সম্পর্কে তাকে একটু হলেও নাড়া দিয়ে যায়, তাই সে সিনেমা হল থেকে বাইরে বের হয়ে এসে বলে,”আমরা এখানেই ভালো আছি”।
ঠিক এমন প্লাটোনিক ভালোবাসার নিবিড় চিত্রায়ন দেখা গেছে কার-ওয়াই এর “ইন দ্য মুড ফর লাভ”(২০০০), সোফিয়া কপোলার “লস্ট ইন ট্রান্সলেশন”(২০০৩), স্পাইক যোঞ্জির “হার”(২০১৩), এ - প্রত্যেকে সিনেমাতেই প্রেমের স্বরুপ বা অন্তরের গভীরে লুকোনো যে সুগভীর চাওয়া-পাওয়া যেটি শরীরী ভালোবাসার তুচ্ছ আবেদন কে ছেড়ে পৌছতে চায় অন্য এক মোকামে, সেই চাওয়া-পাওয়ার যাত্রায় নতুন সংযোজন রিতেশ বাতারার “ফটোগ্রাফ”।

রাসগুল্লা ও গোলাবজামুন


প্রচলিত ধারার বাইরের এই প্রায় প্রেমের গল্পটিকে সবচেয়ে সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন রাফির দাদী, সিনেমার একটি সংলাপে তিনি বলেন,
“বিলকুল এইসা লাগ রাহা হ্যায় কি এক প্লেট ম্যা রাসগুল্লা অর গোলাব জামুন”।


এই সিনেমার তারকা হচ্ছে এর গল্প। বলিউডের ফর্মূলা সিনেমার মতো তারকার ওপর ভর করে বানানো সিনেমা নয় এটি। যে কারনে নওয়াজুদ্দিন বা সোনিয়ার থেকেও বেশি হাইলাইটেড হচ্ছে সিনেমার গল্প।


সিনেমার শুরুটা অগোছালো, বাধোবাধো ঠেকলেও পুরো সিনেমা জুড়ে গল্পের সাথে যথোপযুক্ত অডিও-ভিজ্যুয়াল সরবরাহ করেছেন পরিচালক রিতেশ। যেভাবে স্ক্রিপ্ট থেকে ফিল্মে একটা গল্প রূপান্তরিত হয়, সেই ব্যাপারটা এখানে বেশ ভালো ভাবে ঘটানো হয়েছে। সেই অর্থে এটি একটি স্মার্ট ফিল্ম। সিনেমা মানেই তো অক্ষরে লেখা গল্প যেই শক্তিতে ও আয়োজনে একটি স্বার্থক অডিও-ভ্যিজুয়াল/ শব্দ ও দৃশ্যের যুগলবন্দি হয়ে উঠে। পুরো চলচ্চিত্র জুড়েই ফটোগ্রাফের মতো একধরনের স্থিরতা রয়েছে, রয়েছে দারুণ কিছু ফ্রেম/কম্পোজিশন।


এতোক্ষণের আলোচবা গভীরভাবে শর্তযুক্ত। কেবল শর্তপূরণ করেই কেউ একজন এই সিনেমা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারে। সিনেমা জীবনের সরাসরি রূপান্তর নয়, আবার জীবন থেকে খুব একটা দূরেও নয়। সিনেমা হচ্ছে রহস্যে আবৃত বাস্তবতা কে জীবনের ভাষা দিয়ে অনুবাদ করে শব্দ ও দৃশ্য সহযোগে পরিবেশন করা। যে কারণে একে ২+২= ৪ এভাবে যারা বুঝে ফেলার আগ্রহ রাখেন, তারা হয়তো প্রথম থেকেই স্বাদ বঞ্চিত হন। একটা ভালো সিনেমার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে একে নানা দিকে নানা ভাবে নানা দর্শনে নানান আলাপে আড্ডার আসর গরম করা যাবে। আর যেই সিনেমা এক কথাতেই ধরে ফেলা যায়, বুঝে ফেলা যায়, বোঝানো যায় তা হয়তো ভালো সিনেমা হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে সিনেমা দেখার মজাও কমে যায় অনেক অংশে।




শেষের কথা
এই সিনেমা দেখে মজা পেতে হলে প্রথমেই আমাদের ছোক ছোক করা অবিশ্বাসের মনোভাবটি একটু বন্ধ রেখে কল্পনার ডানা মেলে দিতে হবে, যার খুব সুন্দর একটা ইংরেজি টার্ম রয়েছেঃ সাস্পেন্সন অফ ডিসবিলিফ( Suspension of Disbelief)। সিনেমার সমাপ্তি অমিমাংসিত ও অপেন-এন্ডেডঃ মেলোনি ও রাফির সম্পর্কের বিস্তার, ক্রমবিকাশ ও ভবিষ্যত কোনোটিই দেখানো হয়নি। মিলোনি আর রাফি হচ্ছে থেসিস আর এনটিথেসিস- সিনথেসিস এর ভার ছেড়ে দিয়েছেন দর্শকের উপর। চিন্তাশীলতার মধ্যে আমাদের রেখে চলতে থাকে রাফি ও মিলোনি। এক ধরনের স্থিরতায় তারা দেখতে থাকে তাদের সম্পর্ক কে। ঠিক একটা ফটোগ্রাফের মতো, যাতে কোনোকিছু ঘটছে না কিন্ত চিন্তা করতে দেয় অনেক কিছু, বন্দি করে রাখে একটি নির্দিষ্ট সময়ের নির্দিষ্ট পাত্র-পাত্রিকে, আর বলতে থাকেঃ আমি একটি সময়ের সাক্ষী।

Comments

Popular posts from this blog

"দেবী" (২০১৮) : জয়া প্রযোজক প্রথমবার নিয়ে কিছু আলাপ,ফিরে দেখা,চেক ব্যাক

L F D: ঢাকার সিসিফাসের গল্প ( Live From Dhaka )