The Truman Show (1998): মাই লাইফ, মাই রুলস?!?


২১ বছর আগে মুক্তি পেয়েছিলো দ্য ট্রুম্যান শো (১৯৯৮, ৫ জুন)।  আপাত নাটকীয়তার আড়ালে চলচ্চিত্রটি আমাদের অস্তিত্ব ও যাপিত জীবনের দিকে প্রশ্ন ছূড়ে দেয়ঃ এ জীবন কার? স্রষ্টা ও সৃষ্টির পারস্পারিক সম্পর্ক কে দার্শনিক চ্যালেঞ্জ জানানো এই চলচ্চিত্র দেখে মনে পড়ে হালের ওয়েস্ট ওয়ার্ল্ডের কথা। সিমুলেটেড জগত থেকে বের হওয়ার যে দুর্দমনীয় বাসনা তা আমরা দেখেছি দ্য ম্যাট্রিক্স এর মতো চলচ্চিত্রেও। এমনকি ক্রিস্টফ কে যদি ঈশ্বরের রূপক ভাবেন, ট্রুম্যান কে ভাবতে পারেন “স্বর্গ” থেকে স্বেচ্ছায় পালিয়ে আসা একজন বেয়াদব সৃষ্টি। তৎকালীন সময়ে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গোপন-প্রকাশ্য সব ধরনের তথ্যের প্রতি অতিরিক্ত কৌতুহল আর ভোগবাদী মতবাদের প্রতি দ্য ট্রুম্যান শো এক ধারালো জবাব বলেও মনে করে অনেকে। আমাজন, ভুডু থেকে স্টারজ, ফ্যানড্যাঙ্গো- বর্তমানে বাজারের জনপ্রিয় সবগুলো অনলাইন প্লাটফর্মে স্ট্রিমিং দেখেই বোঝা যায়, এর আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি।

মৌলিক চিত্রনাট্য, শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেতার জন্য অস্কার মনোনয়ন, ৮ লক্ষ ৩৭ হাজার মানুষের ভোটে রেটিং ৮.১। রোটেন টম্যাটোতে ১২৫ রিভিউ এর বিপরীতে ৯৪% ফ্রেশ , ৫ লক্ষ ৮৩ হাজার মানুষের ভোটে ৮৯% অডিয়েন্স রেটিং। জেনে নেই মুক্তির ২১ বছর পার করা জিম ক্যারির অনবদ্য অভিনয়শৈলির সাই-ফাই ড্রামার কিছু চিত্তাকর্ষক তথ্য!

    • নিউ ইয়র্ক টাইমস- এর ২০০৮ সালের এক প্রবন্ধ অনুযায়ি, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে “ট্রু-ম্যান সিন্ড্রোম” বা “দ্য ট্রু-ম্যান শো ডিলিউশন” নামক উপসর্গ দেখা দেয় বলে জানান কতিপয় মনোবিদ। আক্রান্ত রোগীরা ভাবতে শুরু করে তাদের জীবন একটা রিয়ালিটি শো এবং নিজেদের অজান্তেই তারা এই টেলিভিশন প্রোগ্রামের অনিবার্য অংশগ্রহণকারি। চিকিৎসা চলাকালে বহু মানুষ এই চলচ্চিত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়োর একজন ছাত্র এন্ড্রু মারাঞ্জ এর নামে নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ বের হয়, যিনি কয়েক বছর ধরে ট্রু-ম্যান-সিন্ড্রোমে ভুগছিলেন!
    • ট্রুম্যান বারবাংক- নামের প্রথম অংশ ট্রু(সত্যি) ও ম্যান(মানুষ) প্লটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শব্দের খেলা। নামের শেষাংশ ক্যালিফোর্নিয়ার একটি জায়গার নাম। ডোমের লোকেশন যেখানে ট্রুম্যান শো ধারণ করা হয় সে জায়গাটির নামও বারবাংক।


    • রব সিল্ভারম্যান নামক একজন শিল্পী ৭৫ হাজার ডলার বা ৬৩ লক্ষ টাকায় চলচ্চিত্রের আইকনিক পোস্টারটির স্রষ্টা। পোস্টারটি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ট্রু-ম্যানের জীবনের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তের সমন্বয়ে তার মুখায়ব গড়ে উঠেছে। প্লটের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ নিখুঁত পোস্টার। নীল পটভূমিতে জিম ক্যারির সামগ্রিক মুখায়ব ব্লার/ঘোলা থাকলেও ছোট ছোট ছবি যেগুলো ট্রুম্যানের জীবনের নানা অংশ বর্ণনা করছে সেগুলো বেশ পরিষ্কার! সিনেমায় অনেক শিল্পী থাকলেও পোস্টারে শুধুমাত্র জিম ক্যারির নামই দেয়া আছে। জিম ক্যারির নাম দেখে লোকে কিছুতেই ভাবতে পারেনি হাস্যরস ছাড়াও এমন গভীর দর্শনের সিনেমাও তাকে দিয়ে সম্ভব!
    • নির্মাতা পিটার ওয়্যার এর মতে, সিনেমাটি পপ সম্রাট মাইকেল জ্যাকসনের জীবনী থেকে অনুপ্রাণিত। প্রসঙ্গত, জ্যাকসনের পুরো জীবন সত্যিকার অর্থেই পৃথিবীবাসীর জন্য এক জীবন্ত অনুষ্ঠানে পরিণত হয়!
    • স্টিভেন স্পিলবার্গ, ব্রায়ান ডি পামা, টিম বার্টন, টেরি গিলিয়াম, ব্যারি সনারফিল্ড, ব্রায়ান সিঙ্গার এমনকি চিত্রনাট্যকার এন্ড্রু নিকোলের এই চলচ্চিত্র দিয়ে পরিচালনায় অভিষেকের কথা থাকলেও তারই পরামর্শ অনুযায়ি প্যারামাউন্ট স্টুডিও নির্মাতা হিসেবে পিটার ওয়্যার কে নির্বাচন করে ।
    • জিম ক্যারির ইম্প্রোভাইজ(improvise) বা তাৎক্ষণিক ভাবে অভিনয় শৈলি আরোপ করার ক্ষমতা দেখে তাকে পছন্দ করেন নির্মাতা পিটার ওয়্যার। পরিচালকের সাথে এর আগে ডেড পোয়েটস সোসাইটি সিনেমায় দারুণ অভিনয় করা রবিন উইলিয়ামস ছিলেন প্রধান চরিত্রের জন্য তার প্রথম পছন্দ! জিম ক্যারি জানান সর্বদা ভক্ত আর পাপারাজ্জিদের নজরদারি তাকে ট্রুম্যান চরিত্রের সাথে মিশে যেতে সাহায্য করেছে! এইস ভেঞ্চুরাঃ পেট ডিটেক্টিভ(১৯৯৪) দেখে নির্মাতা জিম ক্যারিকে মূল চরিত্রের জন্য বাছাই করেন। পরবর্তীতে পিটার ওয়্যার জানান ঐ সিনেমায় জিম ক্যারি তাকে চার্লি চ্যাপলিনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো!
    • ক্রিস্টোফ চরিত্রটির জন্য প্রথমে ডেনিস হপার চুক্তিবদ্ধ হলেও শ্যুটিং এর প্রথম দিনেই তিনি বিদায় নেন, তার স্থলাভিষিক্ত হন এড হ্যারিস। বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে, ডেনিস হপার এডটিভি(১৯৯৯) চলচ্চিত্রের জন্য ছেড়ে যান, তার সাথে ট্রু-ম্যান শো সিনেমার রয়েছে ব্যপক মিল।

    • শ্যুটিং চলাকালিন এড হ্যারিস ও জিম ক্যারি কখনোই পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ করেননি।
    • চলচ্চিত্রে সী-হ্যাভেন অঞ্চলের প্রতিটি সরণির নাম একেকজন চলচ্চিত্র অভিনেতার নামে। যেমনঃ “ল্যাংকাস্টার স্কয়ার”, “ব্যারিমোর সড়ক”। এমনকি চলচ্চিত্রের অন্যান্য কুশিলবগণের নামও সিনেমা জগতের মানুষের নামানুসারে দেয়াঃ মেরিল, মার্লন, লরেন ইত্যাদি!
    • নির্মাতা পিটার ওয়্যারের পরিকল্পনা ছিলো প্রতিটি সিনেমা হলে ক্যামেরা বসানো থাকবে। এক পর্যায়ে চলচ্চিত্র থামিয়ে বিভিন্ন হলের দর্শকদের ফুটেজ দেখানো হবে স্ক্রিনে! এমনকি ট্রুম্যানের পরিচালক ক্রিস্টোফ চরিত্রটি পিটার ওয়্যার নিজে করার পরিকল্পনা করেছিলেন যাতে পুরো ব্যাপারটি আরো একটু নাটকীয় হয়।
    • ১৯৯৮ সালে ৬০ মিলিওন ডলার বাজেটের কারনে প্যারামাউন্ট পিকচার্স এই ফিল্ম কে “ সর্বকালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল আর্টফিল্ম” অভিধা দিয়েছিলো। তারা চেয়েছিলো চলচ্চিত্রটি যেন হাস্যরসের পরিপূর্ণ হয়, নাটকীয়তা বা দর্শনের জটিলতা যেন কম থাকে। পিটার ওয়্যার চিত্রনাট্য পড়েও বলেছিলেন এটি খুব ডার্ক ও অস্পষ্ট। চিত্রনাট্যকার এন্ড্রু নিকোল কে সর্বমোট ১৬টি খসড়া লিখতে হয় চলচ্চিত্র উপযোগী করে তোলার জন্য।
    • টেলিভিশন শো এর সাথে মিল রাখার জন্য পুরো চলচ্চিত্র ১.৬৬ঃ১ র‍্যাশিও তে ধারণ করা হয়। শুধুমাত্র অরিজিনাল ডিভিডি এই ফরম্যাটে ছিলো, থিয়েটারের জন্য ১.৮৫ঃ১ এবং ব্লু-রে রিলিজের জন্য অনুসরণ করা হয়েছিলো ১.৭৮ঃ১ ফরম্যাট!
    • ফিলিপ কিন্ড্রেড ডিকের সাই-ফাই “টাইম আউট অফ জয়েন্ট” (১৯৫৯) উপন্যাসের বিষয়বস্তু ছিলোঃ নিজের অজান্তেই একজন মানুষ অল্টারনেট রিয়ালিটিতে বসবাস। এই উপন্যাসের সাথে ব্যাপক মিল রয়েছে ট্রুম্যানের।




    • মিডিয়া এথিক্স কোর্সে এই চলচ্চিত্র পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত। বিশেষ করে ক্রিস্টোফ, মারলোন এবং ট্রুম্যানের স্ত্রী মেরিল - এই চরিত্রগুলোর নিবিড় পাঠ নেয়া হয়!
    • ক্রিস্টোফার কলাম্বাসের জাহাজের নাম অনুযায়ি ট্রু-ম্যানের নৌকার নাম থাকে সান্তা মারিয়া
    • সেলেব্রেটিদের/ তারকাদের জীবন কতটা শ্বাসরোধী ও যন্ত্রণার হতে পারে সেটিকে খেয়াল রেখে কোরিয়ার শিল্পী জি ইয়ুং কোন তার এলবামে ট্রুম্যানের একটি লাইন অন্তর্ভুক্ত করেন। "Good morning, and in case I don't see ya, good afternoon, good evening, and good night!"
    • জিম ক্যারির ফিল্ম ক্যারিয়ারের প্রথম বড় পদক্ষেপ। “ সেই সময় আমার পড়া অন্যতম সেরা চিত্রনাট্য ছিল এটি, বহুমাত্রিক অর্থের কারণে এটি ছিলো দারুণ আকর্ষনীয়”- চিত্রনাট্য পড়েই মুগ্ধ হওয়া জিম ক্যারি বলেন তার প্রথম প্রথম বড় আয়োজনের ও গভীরতার প্রধান চরিত্র নিয়ে বলেন।
    • মূল চিত্রনাট্যে ট্রু-ম্যান চরিত্রটি সদ্য হাইস্কুল পাশ করা শিক্ষার্থীর থাকলেও জিম ক্যারির বয়সের কারনে একে টিন এজ জটিলতা থেকে মধ্য বয়সের জটিলতার মধ্যে চিত্রিত করা হয়েছে।

    তথ্যসুত্রঃ আইএমডিবি, ইউটিউব, ইন্টারনেটের কোনাকাঞ্চি


      Comments

      Popular posts from this blog

      "দেবী" (২০১৮) : জয়া প্রযোজক প্রথমবার নিয়ে কিছু আলাপ,ফিরে দেখা,চেক ব্যাক

      L F D: ঢাকার সিসিফাসের গল্প ( Live From Dhaka )

      ভারত অস্কারে পাঠাচ্ছে গালিবয়ঃ সেরা সিনেমা বনাম ফিল্ম সার্কিট পলিটিক্স